দেশে কয়েক মাসের মধ্যে ডলারের দাম বেড়েছে ২০ শতাংশের বেশি। হঠাৎ করেই ডিজেলের দামও বেড়েছে ৪২ শতাংশ। এই দুই দাম বৃদ্ধির সরাসরি ভুক্তভোগী হয়েছে দেশের নির্মাণ খাত। জ্বালানি এবং ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে সর্বকালের সর্বোচ্চ অবস্থায় পৌঁছেছে নির্মাণ শিল্পের অন্যতম উপকরণ রড। তার সঙ্গী হয়েছে সিমেন্ট। কারণ রড তৈরির কাঁচামাল স্ক্র্যাপ ও সিমেন্ট উৎপাদনের কাঁচামাল ক্লিংকারের পুরোটাই দেশে আসে আমদানি হয়ে। এর মূল্য পরিশোধ করতে হয় ডলারে। আর পরিবহন করতে হয় জাহাজ ও ট্রাকে।
রড-সিমেন্টের ডিলার, মিলমালিক এবং সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন নির্বাহীদের সঙ্গে কথা বলে একমাসের বাজার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বর্তমানে প্রতি টন এমএস রড বিক্রি হচ্ছে ৯০ হাজার থেকে ৯২ হাজার ৩শ টাকায়। এর আগে কখনো রডের দাম এত বেশি হয়নি। একমাস আগেও এসব রড ছিল ৮৫-৮৬ হাজার টাকা। আবার ৫০ কেজির প্রতি বস্তা সিমেন্ট বিক্রি হচ্ছে ৫০০-৫৩০ টাকায়। এর আগে গত মার্চে সিমেন্টের দাম ৫২০ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। তবে একমাস আগে এসব সিমেন্ট ছিল ৪০০-৪২০ টাকা।

পঞ্চবটীর এক রড ব্যবসায়ী জানান, বাজারে রড-সিমেন্টের দাম হু হু করে বাড়ছে। একমাসের ব্যবধানে রডের দাম প্রতি টনে ৫-৮ হাজার টাকা বেড়েছে।
তিনি বলেন, বর্তমানে বিএসআরএম ব্র্যান্ডের এমএস রড ৯২ হাজার ৩শ টাকা, কেএসআরএমের রড ৯০ হাজার ৫শ টাকা, একেএস ৯১ হাজার ৫শ এবং জিপিএইচ ৯১ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
ফতুল্লার এক সিমেন্ট ব্যবসায়ী বলেন, বাজারে বর্তমানে ৫শ টাকার নিচে কোনো সিমেন্ট নেই। মাসের ব্যবধানে ৫০ কেজির প্রতি বস্তা সিমেন্টের দাম বেড়েছে ১০০-১২০ টাকা। বর্তমানে ডলার এবং জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে রড-সিমেন্টের দাম বাড়ছে। এ কারণে বিক্রি একেবারে কমে গেছে।

প্রিমিয়ার সিমেন্টের মহাব্যবস্থাপক গোলাম কিবরিয়া বলেন, সিমেন্ট শিল্পের কাঁচামালের প্রায় পুরোটাই আমদানিনির্ভর। বর্তমানে দেশে ৩৫টি সিমেন্ট কারখানায় উৎপাদন চালু রয়েছে। এর মধ্যে ৩৪টিতে ক্লিংকার আমদানি করে সিমেন্ট উৎপাদন করে থাকে। একব্যাগ সিমেন্ট তৈরিতে ৫০০ টাকা খরচ হলে ৪০০ টাকায় খরচ হয় কাঁচামালে। এখন ডলারের যে হারে দাম বেড়েছে তাতে শুধু সিমেন্ট নয়, আমদানিনির্ভর সব শিল্পই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
তিনি উদাহরণ টেনে বলেন, আমরা সর্বশেষ একটি এলসির মূল্য পরিশোধ করেছি প্রতি ডলার ১১২ টাকা ৫০ পয়সা হারে। ওই এলসিতে দুই কোটি ৯০ লাখ টাকা লোকসান দিতে হয়েছে। এখন টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে প্রায় ২৯ শতাংশ। তার প্রভাব পড়েছে উৎপাদনে। এখন শুধু ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে প্রতি বস্তায় ৭০-৮৫ টাকা দাম বেড়েছে। আবার আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম বাড়তি থাকায় সারাবিশ্বে বাংকারিংয়ের দাম বেড়েছে। এতে জাহাজ ভাড়াও বেড়ে যায়। ক্লিংকারের আমদানি খরচ বেড়ে গেছে। ফ্রেইট চার্জ বেড়ে যাওয়ার কারণে এখন ক্লিংকার ৬২-৬৩ ডলারে কিনতে হচ্ছে।
দেশে ডিজেলের দাম বাড়ার সরাসরি প্রভাবও পড়েছে এ খাতে। ডিজেলের বাড়তি দামের কারণে ট্রাক ও লাইটার জাহাজের ভাড়া বেড়েছে বলে জানান প্রিমিয়ার সিমেন্টের এই কর্মকর্তা।
দেশের রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাহীরাও বলছেন, ডলারের দাম বৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক বাজারে স্ক্র্যাপের দাম বাড়ার কারণে দেশে রডের দামে রেকর্ড হয়েছে। এখন কেউ বাধ্য হয়ে উৎপাদন বন্ধ রাখছেন আবার কেউ লস দিয়েও ব্যবসা চালিয়ে নিচ্ছেন।
দেশের শীর্ষ রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান জিপিএইচ ইস্পাতের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলমাস শিমুল বলেন, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে ইস্পাত শিল্পের উদ্যোক্তারা বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছে। ডেফার্ড পেমেন্ট এলসিতে (পরে পরিশোধ) স্ক্র্যাপ আমদানি করা হয়। ডেফার্ড এলসির কারণে আমরা আমদানির ৬ মাস পর এলসি মূল্য পরিশোধ করি। ৬ মাস আগে ডলারের মূল্য ছিল টাকা। সেই হিসেবে কস্টিং করে উৎপাদিত রড বিক্রি করে দিয়েছি। এখন ডলার হয়ে গেছে ১১২ টাকা। এতে প্রতি ডলারে আমাদের ১৮ থেকে ২২ টাকা পর্যন্ত লোকসান দিতে হচ্ছে। প্রতি টন স্ক্র্যাপে ৫০০ ডলার পরিশোধ করতে হলে টাকায় ১০ হাজার টাকা বেশি পরিশোধ করতে হয়