নারায়ণগঞ্জ-এর যত বিলুপ্ত খেলাধুলা

শেয়ার করুণ

আমার বেড়েওঠা আমাদের নারায়ণগঞ্জ শহরেই।ছোটবেলা থেকে কত রকম খেলাধুলা আমি নিজে খেলে বড় হয়েছি,আর খেলা খেলতে দেখেছি। যে সকল খেলা আমি দেখেছি, খেলেছি তার প্রায় সবগুলোই আজ বিলুপ্তপ্রায়। নামগুলো শুনলেই পাঠকসমাজ ক্ষনিকের জন্য চোখের পলকে তাঁদের শৈশব-কৈশোরে হারিয়ে যাবেন।

কাবাডিঃ

কাবাডি খেলা নারায়ণগঞ্জে কম খেলা হতে দেখলেও,কমবেশি হতে দেখেছি,নিজেও কয়েকবার খেলেছি।

খেলার মাঝে একটি ঝোঁক, শারীরিক শক্তিমত্তা ও বুদ্ধির প্রমাণ দিয়ে এই খেলায় দক্ষতা প্রদর্শন করতে হয়। খেলাটি দুই দলে বিভক্ত দলে নির্দিষ্ট সংখ্যার খেলোয়ার থাকে।দুইটি নির্দিষ্ট সীমাবদ্ধ ঘর থাকে। উভয় দলের খেলোয়ার একজন অপরজন করে বিপরীত ঘরে গিয়ে দলের খেলোয়াড়দের ছুয়ে আসতে পারলে পয়েন্ট অর্জন করে এবং একটা সময়ে কম বেশি পয়েন্টে দলের জয় পরাজয় নিশ্চিত হয়। বর্তমান সমাজে অনেকে হয়ত এই খেলার নামও জানে না।পর্যাপ্ত খেলার মাঠ না থাকায় এরকম একটি ঐতিহ্যবাহী খেলা আজ বিলুপ্ত।

কানামাছিঃ

“কানামাছি ভোঁ ভোঁ যাকে পাবি তাকে ছো”- এই ছড়া শোনেনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। এ খেলায় একজনের চোখ বেধে দেওয়া হয় এবং অন্যান্য খেলোয়াড় সবাই তাঁর চারপাশে ঘোরাঘুরি করতে থাকে।

চোখ বেঁধে দেওয়া খেলোয়াড় যে কাউকে ছুয়ে দিতে পারলে তখন সে মুক্তি পায় এবং ছুয়ে দেওয়া খেলোয়াড়ের চোখ বেঁধে পুনরায় খেলা চলতে থাকে। শৈশব-কৈশোরে এই খেলা না খেলে থাকলে তাঁর শৈশব আছে বলে মনে হয় না। দুঃখজনক হলেও সত্য যে,বর্তমান সমাজে এই খেলাটি আর দেখা যায় না।

কুতকুতঃ

আমার বেড়েওঠা সঙ্গী-সাথিদের সাথে অনেক খেলার মাঝে কুতকুত খেলা অন্যতম। এই খেলা ছেলে-মেয়ে উভয় শিশুই খেলতাম।

আয়তাকারের মত মোট ৭ বা ৮ টি ঘর আঁকা হতো এবং শেষ ঘরের বেলায় অর্ধচন্দ্রাকার একটি ঘর বানানো হতো। প্রথম ঘরে গুটি ফেলে এক পা শূন্যে রেখে এবং দম দিতে দিতে গুটিকে সবগুলো ঘর অতিক্রম করে অর্ধচন্দ্রাকার ঘর পর্যন্ত আনার পর দম ছাড়া হতো।এবং পুনরায় আগের নিয়মে পূর্বাবস্থায় ফিরে যেতে হতো। এভাবে একের পর এক ঘর এগিয়ে গিয়ে সবগুলো ঘরের খেলা শেষে খেলোয়ার উপরের দিকে অথবা চোখবুঁজে সকল ঘরে পা রেখে কোনো ঘরের সীমানা দাগে পা না রেখে ফিরে আসতে হতো।এরপর দাত দেখা যাবে না বা ‘হাম’, জিম বলে পুনরায় সকল ঘর অতিক্রম করার পর খেলোয়াড় ঘর কেনার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে।এবং সেই ঘরে অপর খেলোয়াড় পা রাখতে পারবে না।চমৎকার এই খেলাটি কিশোর-কিশোরীদের উপভোগ্য খেলা হলেও আজ তা অচেনা অজানা।

মার্বেলঃ

কিশোর সমাজের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও আকর্ষণীয় খেলা হলো মার্বেল খেলা। এই মার্বেল যে কত খেলেছি,কত মধুময় সৃতি জড়িয়ে রয়েছে তা ভাষায় প্রকাশ করার মত না। কমপক্ষে দুইজন ও ৩,৪,৫ বা ততোধিক খেলোয়াড় একসাথে খেলা যায়।প্রত্যেকেই ব্যক্তি পর্যায়ে খেলে থাকে। এই মার্বেলে আন্টিশ খেলায় আমার হাতের পাঁচ আঙুলেই আমি চমৎকার খেলতে পারতাম,মাঝে মাঝে তাতেও বসে থাকতে হতো। আন্টিশ খেলায় একটি ছোট গর্ত করে তাকে নারায়ণগঞ্জের ভাষায় ‘ডিপ’ বলা হয়।প্রত্যেকের সুযোগে ডিপ থেকে মার্বেলে অথবা মার্বেল লাগিয়ে ডিপ করলে বিজয় অর্জন করা যায়। এছাড়া প্রচলিত ভাষায় “জয়মির(দান দান) জোড়-বেজোড়,গিব্বা(বিঘত মেপে),নাক্কি-ধোয়া নামের বিচিত্র সব খেলায় উপভোগ্য সময় কাটানো সেই শৈশব এখন স্বপ্নের মতো।

লাটিম (লাড্ডু খেলা):

মার্বেলের মতোই প্রচুর খেলেছি লাটিম খেলা। প্রচলিত ভাষায় এর নাম হয় “লাড্ডু খেলা”। লাটিম শব্দটিতে আমার শৈশব কৈশোরের অনেক সময় কেটেছে আন্দের জোয়ারে ভেসে। লাটিম খেলার নিয়ম-কানুন নারায়ণগঞ্জের মানুষের অজানা নয়। ঘরকোপ,ঝিমকোপ,সাতগজা, দা-কোপ খেলাগুলো আমরা সচরাচর খেলতাম।তবে সবচেয়ে বেশি খেলতাম লাটিম(লাড্ডু) জেতার খেলা। এ খেলায় পাড়ার কয়েকজন খেলোয়াড় যারপরনাই পারদর্শী ছিলো।আমি সহ কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু, খেলার সাথী আমরা ভরপুর খেলেছি আমাদের প্রিয় এই লাড্ডু খেলা।আমার ঘরে এখনো নানারকম লাটিমের কিছু ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যেতে পারে।আজকাল ছেলেদের লাটিম খুব কম খেলতে দেখি,আর তা শুধু লাটিম কোনরকমে ঘুড়ানোর মাঝেই সীমাবদ্ধ।

ঘুড়ি ওড়ানোঃ

কৈশোরের অন্যতম প্রিয় খেলা এই ঘুড়ি ওড়ানো।আমি খুব বেশি খেলিনি তবে খেলার চেয়ে ওড়ানো দেখা ভালো লাগতো। রঙ মাখিয়ে,সাবুদানা বা কাঁচ গুড়ো, বার্লি এসব কিছু উপাদান গুলিয়ে সুতা মাঞ্জা দিয়ে কাটাকাটি খেলার জন্য নাটাই তে পেঁচিয়ে নেওয়া হতো সুতাগুলো। ঘুড়ি উড়িয়ে আকাশে উড়তে থাকা ঘুড়ির সাথে ‘প্যাচ’ বা ডিপ্পো খেলা এবং কে কার ঘুড়ি কেটে বাতাসে ভাসিয়ে দিতে পারেতার মাঝেই আনন্দ খুঁজে পাওয়া। আমরা বলে উঠতাম ” বাগেট্টা…লোট লোট” কালিবাজারে মুরগী নাই ইত্যাদি সব সুন্দর সুন্দর ছড়াকাটা।

দাঁড়িয়াবাঁন্ধাঃ

আহ! কৈশোরের কতই না জনপ্রিয় খেলা এই দাঁড়িয়াবাঁন্ধা বা “দাইড়াকোট” খেলাটি।এটি দেশের সর্বত্রই আঞ্চলিক নিয়ম অনুসারে খেলা হয়,কিছু কিছু নিয়মের পার্থক্যও রয়েছে।খেলার মাঠ সাধারণ খেলোয়াড় সংখ্যা বিবেচনায় ঘর সংখ্যা নিধারণ করে ঘরের দাগ কাটা হয়।খেলায় অবশ্যই দুটি দলের মাঝে হয়ে থাকে। আজকাল এই খেলা শিশুদের কাছে অলীক কল্পনা মনে হলেও তাতে অবাক হবার কিছু নেই।

ডাংগুলি(ডান্ডা গুডি):

নারায়ণগঞ্জে একসময় এই খেলাও কম খেলা হয়েছে তা নয়। আমি যেহতু খেলেছি সুতরাং একা খেলতাম না।খেলার সঙ্গী-সাথীদের সাথেই খেলতাম। ক্রিকেট-ফুটবলের জনপ্রিয়তার মাঝে এই খেলা হারিয়ে গেলেও আমার শৈশবে অনেক খেলার মাঝে এই খেলা অন্যতম। দেড়হাত লম্বা একটি লাঠি ও এক বিঘত পরিমান লম্বা একটি শক্ত লাঠি এই খেলার উপকরণ। প্রথমে খেলার মাঠে একটি গর্ত করা হয়। সুযোগ মত একজন খেলোয়াড় সেই গর্তে ছোট লাঠি রেখে বড় লাঠি দিয়ে সেটিকে দুরে ফেলার চেষ্টা করে।প্রতিপক্ষের খেলোয়াড় আশপাশের ছড়িয়ে থাকে এবং ছোট লাঠিকে শূন্য থেকে লুফে নেওয়ার চেষ্টা করে।লুফে নিলেই আউট। লুফে নিতে না পারলে গর্ত কেন্দ্র করে ছোট লাঠিকে ছুরে মারতে হয়।নির্দিষ্ট দুরত্বের মাঝে না এলে সুযোগ প্রাপ্ত খেলোয়াড় বড় লাঠি দিয়ে ছোট লাটির এক কোণায় আঘাত করে সেটিকে শূন্যে ভাসিয়ে ছোট ছোট আঘাত করে সেটিকে দুরে পাঠিয়ে দেয় এবং তারপর সেই দুরত্ব মাপা হয় ছোট লাঠি থেকে গর্ত পর্যন্ত।দুরত্ব মাপার উপকরণ হয় বড় লাঠি।

প্রথমে যে দল নির্দিষ্ট সংখ্যার গণনা পর্যন্ত পয়েন্ট অর্জন করে সে দল জয়ী হয়। প্রচুর জনপ্রিয়তা থাকলেও আজকের সমাজে এই খেলা নেঃ বললেই চলে। এছাড়া এই খেলাটি ছোটদের জন্য আঘাত পাওয়া বা বিপদের ঝুঁকি থাকায় মুরুব্বি সমাজ এই খেলা খেলতে মানা করতেন।

গোল্লাছুটঃ

একসময় কিশোর-কিশোরী সমাজে এই খেলার তুমুল জনপ্রিয়তা ছিলো। সাধারণত স্কুলে প্রাঙ্গণে আমরা এই খেলা খেলতাম। গোল্লাছুট খেলায় দুটি দল থাকে।মাটিতে এক জায়গায় একটি গর্ত করে একটি লাঠি পুতে তাকে কেন্দ্র ধরতাম।এই লাঠি কেন্দ্রিক একটি বৃত্ত তৈরি করে ২০-২৫ ফুট দুরে আরো একটি রেখা টেনে সীমানা নির্ধারণ করতাম।দুদলের মাঝে দুজন দলপতি থাকতো এবং উভয় দলে সমান সংখ্যক খেলোয়াড় নিয়ে খেলা শুরু করা হতো। দলপতি মাটিতে পুতে রাখা লাঠি একহাতে ধরে অপর হাতে পর পর পরস্পর খেলোয়াড়দের হাত ধরে কেন্দ্র স্পর্শ করে ঘুরতে থাকে।তাঁদের লক্ষ্য হলো বৃত্তের বাইরে যে কাঠি বা গাছ তাকে দৌড়ে স্পর্শ করা।

লুকোচুরি ( চোখ পলান্তিস):

আমাদের শৈশব-কৈশোরের ব্যাপক খেলার অন্যতম খেলা লুকোচুরি বা ‘চোখ পলান্তিস’। কয়েকজন খেলোয়াড় বাটাবাটি করে একজন চোর হতো এবং নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে ৫০ বা ১০০ পর্যন্ত গননা করে বাকি খেলোয়াড়দের খোঁজা শুরু করে দিতো। প্রথম যাকে ১ টিল্লো বা দেখা হতো সে পরবর্তী দানের জন্য চোর নির্ধারিত হতো। একই চোর আবার বার বার চোর থাকতো যদি সে সকল খেলোয়াড়দের খুঁজে বের করার আগে কোন খেলোয়াড় চোরের অগোচরে তার মাথায় হাত বুলিয়ে ‘টিল্লো’ শব্দটি উচ্চারণ করতে পারতো। অঞ্চলভেদে এই খেলার নানাবিধ নিয়ম-কানুন থাকলেও সকল সমাজেই এর জনপ্রিয়তার কমতি ছিলো না। তবে বর্তৃমানে এই খেলার প্রচলন প্রায় শতভাগই বিড়ল।

এছাড়াও কতিপয় কিছু খেলা যদিও আমাদের শৈশবে সময় কাটানো ও মজা করার নিত্যসঙ্গী ছিলো,তবে সেগুলোও আজ বিলুপ্তপ্রায়। যেমনঃপুতুলখেলা,পুকুরে বা স্থলে ছোঁয়াছুঁয়ি, বরফ-পানি,চোর-পুলিশ,সাত চারা, পিঠ ফাটানো,টেবিলে কলম টোকাটুকি খেলা,দৌড়-ঝাপ,বউচি,টোপাভাতি(জোলাপাত্তি),মোরগ লড়াই,বড়ই বীজ,জলপাই বীজ,লিচু বীজ দিয়ে খেলা,সিগারেট বা ম্যাচের খোলস দিয়ে খেলা ইত্যাদি। উল্লেখ্য যে,উপরোল্লিখিত সকল খেলাই আমি খেলেছি,আর ফুটবল,ব্যাডমিন্টন সহ ক্রিকেট খেলেছি অনেক।এখনোও সময় পেলে ক্রিকেট খেলায় মেতে উঠি। এই খেলাগুলো যতসামান্য বর্তমান থাকলেও উপরে উল্লেখ করা প্রায় সকল খেলা আমাদের নারায়ণগঞ্জ শহরে প্রায় বিলুপ্ত। শৈশব-কৈশোরের এই জাদুকরী সৃতি আমাকে সেই হারনো কৈশোরে হারিয়ে যেতে বাধ্য করে, হয়ত বা আপনাকেও।

নিউজটি শেয়ার করুণ