২০০১ সালের ১৬ জুন নগরের প্রাণকেন্দ্র চাষাঢ়ায় আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে নৃশংস বোমা হামলায় প্রাণ হারান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীসহ ২০ জন। ভয়াবহ বোমা হামলার ২২ বছর পূর্ণ হলেও এখনও হয়নি বোমা হামলার বিচার। এই ঘটনার পর টানা তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় রয়েছে। তবে বিচার প্রক্রিয়া ধীরগতিতে চলায় ক্ষোভ রয়েছে নারকীয় এই হত্যাযজ্ঞে নিহত ও আহতদের পরিবারে। অনেকেই বিচার পাওয়ার আশাও ছেড়ে দিয়েছেন।
জানা গেছে, ২০০১ সালের ১৬ জুন নগরের প্রাণকেন্দ্র চাষাঢ়ায় আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে নৃশংস বোমা হামলায় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীসহ ২০ জন প্রাণ হারান।নিহতরা হলেন, তৎকালীন শহর ছাত্রলীগের সভাপতি সাইদুল হাসান বাপ্পি, সরকারি তোলারাম কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক জিএস আকতার হোসেন ও তার ভাই সংগীতশিল্পী মোশাররফ হোসেন মশু, সংগীতশিল্পী নজরুল ইসলাম বাচ্চু, ফতুল্লা থানা আওয়ামী লীগের তৎকালীন যুগ্ম সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন ভাসানী, নারায়ণগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ বি এম নজরুল ইসলাম, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা সাইদুর রহমান সবুজ মোল্লা, মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী পলি বেগম, ছাত্রলীগকর্মী স্বপন দাস, কবি শওকত হোসেন মোক্তার, পান-সিগারেট বিক্রেতা হালিমা বেগম, সিদ্ধিরগঞ্জ ওয়ার্ডের মেম্বার রাজিয়া বেগম, যুবলীগ কর্মী নিধুরাম বিশ্বাস, আব্দুস সাত্তার, আবু হানিফ, এনায়েতউল্লাহ স্বপন, আব্দুল আলীম, শুক্কুর আলী, স্বপন রায় ও অজ্ঞাত এক নারী।
আহত হন সংসদ সদস্য শামীম ওসমানসহ অর্ধশতাধিক। অনেকেই চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করে। বোমা হামলার ঘটনার পরদিনই তৎকালীন শহর (বর্তমান মহানগর) আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. খোকন সাহা বাদী হয়ে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাড. তৈমুর আলম খন্দকারকে প্রধান ও আরও কয়েকজন বিএনপি নেতা-কর্মীকে আসামি করে দন্ডবিধি ও বিস্ফোরক আইনে পৃথক দু’টি মামলা করেন। পরে চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। অন্যদিকে বোমা হামলায় নিহত ফুটপাতের পিঠা বিক্রেতা হালিমা বেগমের ছেলে কালাম বাদী হয়ে শামীম ওসমান ও তার দুই ভাইসহ আরও কয়েকজনকে আসামি করে পৃথক আরেকটি মামলা করেন। যদিও উচ্চ আদালতের নির্দেশে মামলাটি পরবর্তীতে খারিজ হয়ে যায়।
গতবছর (১৫ জুন) গণমাধ্যম কর্মীদের সাথে নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ায় আওয়ামীলীগ কার্যালয়ে বোমা হামলার বিচার কাজ সম্পন্ন না হওয়ার বিষয়ে শামীম ওসমান বলেন, আমার কাছে অপরাধবোধ হয় যে এতগুলো লোক আমার কারনে মারা গেল। আমি হাতজোর করো মাফ চাই তাদের পরিবারের কাছে। আমি চেষ্টা করেছি। চেষ্টায় ত্রুটি রাখি নি। যদি বিচারটা হত তাহলে অন্তত মনটা শান্তি পেত। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি এ ধরণের অপরাধ যারা করেছে তাদের বিচার হবে। তবে মনের ভেতর একটাই সংশয়, বিচারটা দেখে যেতে পারব তো? কারণ বয়স তো বেড়ে যাচ্ছে।
দীর্ঘ তদন্ত শেষে ২০০৩ সালে বিস্ফোরক মামলায় ২৭ জনকে ও ২০১৩ সালে হত্যা মামলায় তদন্তকারী সংস্থা ২২ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করে। এ মামলায় গ্রেফতার হন তৎকালীন বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টু, ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের কমিশনার আরিফুল ইসলাম, নারায়ণগঞ্জ জেলা যুবদল নেতা শাহাদাত উল্লাহ জুয়েল, হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি হান্নানসহ ১০ জন। আসামিদের মধ্যে বৃটিশ হাই কমিশনারের উপর বোমা হামলার মামলায় মুফতি হান্নানের মত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছে। কারাগারে রয়েছে আদালতে একমাত্র স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেওয়া শাহাদাত উল্লাহ জুয়েল ও আব্দুস সালাম পিন্টু। ভারতে গ্রেফতার হন সহোদর আনিসুল মোরছালিন ও মাহাবুবুল মুত্তাকিম। জামিনে রয়েছেন নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর ও বিএনপি নেতা শওকত হাসেম শকু ও ওবায়দুল হক। বাকি আসামিরা পলাতক রয়েছে।
সাক্ষীদের না পাওয়ায় মামলার বিচারকার্য বিলম্বিত হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সরকারী কৌঁসুলি মনিরুজ্জামান বুলবুল। তাঁর ভাষ্য, সাক্ষীদের নাম ও ঠিকানা অনুযায়ী সমন ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হলেও তাঁদের পাওয়া যাচ্ছে না। তাই সাক্ষীদের খুঁজে বের করতে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তারা কাজ করছেন।
স্বামী হত্যার বিচার না পেয়ে ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছেন বোমা হামলায় নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী হামিদা ইসলাম। তিনি বলেন, ‘২২ বছরেও স্বামী হত্যার বিচার পেলাম না। আমার সন্তানেরা তার বাবাকে বাবা বলে ডাকতে পারল না। যারা এতগুলো পরিবারকে ধ্বংস করল, তাদের বিচার চাই, বিচার না হওয়া পর্যন্ত খুনিদের বিচার চেয়ে যাব।’
মামলার বাদী ও নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক খোকন সাহা বলেন, সমন জারি করলেও সাক্ষীরা সাক্ষ্য প্রদান করতে না আসায় মামলার বিচারকার্য বিলম্বিত হচ্ছে।
তবে ২০২০ সালের ৭ জুন নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আদালতে এই ঘটনার সাক্ষ্য দেয়ার এক পর্যায়ে শামীম ওসমান বলেন, ‘নির্দোষ ব্যক্তিরা এই মামলায় শাস্তি পাক আমি তা চাই না। বিএনপি নেতা তৈমুর আলম ও শকু এই ঘটনার সাথে জড়িত না বলে আমি মনে করি।’
সাক্ষ্য প্রদান শেষে আদালত প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের সামনেও কথা বলেন শামীম ওসমান। এক প্রশ্নের জবাবে শামীম ওসমান বলেন, ‘সুষ্ঠু তদন্ত না হওয়া পর্যন্ত আমি কাউকে অপরাধী মনে করি না। আর আমি মনে করি না যে, কাউন্সিলর শকু এটার সাথে জড়িত।’