আরাম আয়েশে জাকির খান

শেয়ার করুণ

সময়ের নারায়ণগঞ্জ : নারায়ণগঞ্জ জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি জাকির খান গত ৩ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার হলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক বলছে অন্তত ক’ বছরখানেক ধরেই তিনি দেশে ছিলেন এবং নিয়মিত অনুগামীদের সঙ্গে দেখা করতেন। মোবাইল নাম্বার পরিবর্তনকরে হোয়াটসআপ বা কোন না কোন মাধ্যমে তাঁর ডেরায় নিয়মিত যোগাযোগ ও যাতায়াত ছিল লোকজনের।

সেখানে আয়োজন করা হতো নানা উৎসবের। কদাচিৎ জাকির খান নিজেও বিভিন্ন স্থানে গিয়ে নানা অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন। তবে প্রকাশের ভয়ে সেসব প্রকাশ
প্রচার না হলেও ২৮ সেপ্টেম্বর তাঁর জন্মদিনে ভেসে উঠে পুরাতন সেইসব ছবিগুলো ফেসবুকে বেশ কয়েকটি আইডি ঘুরে দেখা গেছে, ২৮ সেপ্টেম্বর প্রথম প্রহরেই জাকির খানকে শুভেচ্ছা জানিয়ে অভিনন্দন জ্ঞাপন করা হয়। সেখানে বলা হয়, ২৮ সেপ্টেম্বর জাকির খানের জন্মদিন।

আর আপলোড করা ছবিগুলোতে দেখা যায় বিভিন্নস্তরের লোকজন ফুল নিয়ে জাকির খানের সঙ্গে দেখা করেছেন, শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন।

ওইসব শুভেচ্ছা বিনিময়ের ছবিতেও স্পষ্ট যে তিনি ক’ বছর ধরেই দেশে অবস্থান করছেন। আর ক্যালেন্ডারের হিসেব মতে যদি ২৮ সেপ্টেম্বর তাঁর জন্মদিন হয়ে থাকে আর সে হিসেবে গত বছরের তথা ২০২১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর তাকে জন্মদিনের যে শুভেচ্ছা জানানো হয় সেগুলো এক বছর পর ২০২২ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর আপলোড
করা হয়েছে।

যদিও সময়ের নারায়ণগঞ্জে আরো তিন বছর আগেই খবর প্রকাশ হয়েছিল যে জাকির খান দেশেই আছেন এবং তিনি নিয়মিত নেতাকর্মী ও অনুগামীদের সঙ্গে দেখা করছেন।

কখনো কালো গ্লাসের গাড়িতে চড়ে নারায়ণগঞ্জও আসেন। কিন্তু গত ৩ সেপ্টেম্বর র‍্যাব-১১ এর নারায়ণগঞ্জের একটি বিশেষ অভিযানে ডিএমপি ঢাকার ভাটারা থানার বসুন্ধরা এলাকা হতে বিদেশী পিস্তলসহ জাকির খানকে গ্রেফতার
করা হয়।


গ্রেফতারের পর আদমজীতে র‍্যাব-১১ এর সদর দপ্তরে সংবাদ সম্মেলনে অধিনায়ক
লে. কর্ণেল তানভীর মাহমুদ পাশা জানান, জাকির খানের নামে ৪টি হত্যাসহ অসংখ্য মামলা রয়েছে এবং বিভিন্ন সময়ে তিনি এসকল মামলায় জেল খাটেন। জেল থেকে
ছাড়া পাওয়ার পর তিনি আরও দুর্ধর্ষ হয়ে ওঠেন। এসময় তিনি নারায়ণগঞ্জ এর দেওভোগ এলাকায় বিশাল সন্ত্রাসী বাহিনী ও মাদকের সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। এক
পর্যায়ে দেওভোগ এলাকার অপর শীর্ষ সন্ত্রাসী দয়াল মাসুদকে শহরের সোনার বাংলা মার্কেটের পিছনে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে শহরের ত্রাস হিসেবে পরিচিত হয়ে
ওঠেন। সবশেষ ২০০৩ সালে সাব্বির আলম হত্যাকান্ডের পরে তিনি দেশ ছেড়ে থাইল্যান্ডে পাড়ি জমান।

এ সময়ে বিভিন্ন মামলায় আদালতে জাকির খান দোষী
সাব্যস্থা হলে বিজ্ঞ আদালত তাকে সাজা প্রদান করেন। এর পর থেকেই গ্রেফতার এড়াতে জাকির খান দেশের বাইরে অবস্থান করছিলেন।
প্রাথমিক অনুসন্ধান ও আসামীকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, আসামী জাকির খানের বিরুদ্ধে ১৯৯৪ সালে সন্ত্রাসমূলক অপরাধ দমন বিশেষ আইনে মামলা দায়ের করা হয়। উক্ত মামলায় আসামী জাকির খানের ১৭ বছরের সাজা হয়। পরবর্তীতে উচ্চ
আদালতে তার সাজা কমে ৮ বছর হলেও তিনি গ্রেফতার এড়াতে দেশে ও বিদেশে প্রায় ২১ বছর পলাতক ছিলেন। মূলত ২০০৩ সালে সাব্বির আলম হত্যা মামলায়
আসামী হলে তিনি আত্মগোপনে চলে যান। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে আরো জানা যায়, তিনি দীর্ঘ দিন থাইল্যান্ডে আত্মগোপনে ছিলেন এবং সম্প্রতি ভারত হয়ে তিনি
বাংলাদেশে আসেন। এরপর থেকে তিনি পরিচয় গোপন করে ঢাকার বসুন্ধরা

আবাসিক এলাকায় স্বপরিবারে বসবাস করছিলেন।

ফ্লাশব্যাক সূত্র বলছে, ১৯৮৯ সালে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের প্রয়াত সংসদ সদস্য নাসিম
ওসমানের হাতে ধরে জাতীয় পার্টির ছাত্র সমাজে যোগদানের মাধ্যমেই জাকির খানের
রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবেশ করেন। তার পিতা দৌলত খান ছিলেন তৎকালীন টানবাজার পতিতালয়ের গডফাদার।

১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর জাকির খানের সাথে নাসিম ওসমানের বিরোধ বাধলে কামালউদ্দিন মৃধার নেতৃত্বে সে ১৯৯৪ সালে বিএনপিতে যোগ দেয়। এক পর্যায়ে দেওভোগ এলাকার অপর শীর্ষ সন্ত্রাসী দয়াল মাসুদকে শহরের সোনার বাংলা মার্কেটের পেছনে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে দুর্ধর্ষ হিসেবে শহরে পরিচিত হয়ে উঠেন জাকির খান। ১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকারের শেষ দিকে জাকির খান
শহরের খাজা সুপার মার্কেটে হামলা ও ভাঙ্গচুরের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় ৭ বছরের সশ্রম কারাদন্ড প্রাপ্ত হয়ে জেলে যায়।

একই বছরে আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসার ৭ মাসের মাথায় কাশীপুর বাংলা বাজার এলাকায় এক ঠিকাদারের কাছে চাঁদা দাবীর অভিযোগে দায়েরকৃত মামলায় দ্বিতীয় দফায় জাকির খানের ৫
বছরের সশ্রম কারাদন্ড হয় এবং জেলে যায়।১৯৯৯ সালে স্বল্প সময়ের জন্য জেল থেকে বের হয়ে জাকির খান জেলা ছাত্রদলের সভাপতির পদটি পেয়ে যান।

আওয়ামীলীগের শাসনামলের শেষ দিকে ২০০০ সালে শামীম ওসমান নারায়ণগঞ্জ থেকে টানবাজার ও
নিমতলী পতিতালয় উচ্ছেদ করে। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পরও প্রায় ৫ মাস জেলে থাকেন জাকির
খান। ওই বছরের ৯ সেপ্টেম্বর শহরের
ডিআইটিতে তাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয় যেখানে জনতার ঢল নামে।

সর্বশেষ ২০০৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারী তৎকালীন জেলা বিএনপির সাধারন সম্পাদক ও বিআরটিসির তৎকালীন চেয়ারম্যান তৈমুর আলম খন্দকারের ছোট ভাই ব্যবসায়ী নেতা সাব্বির আলম খন্দকার আততায়ির গুলিতে নিহত হয়। এ ব্যাপারে জাকির খানকে আসামী করে মামলা দায়ের করেন তৈমুর আলম খন্দকার। এর পর জাকির খান নারায়ণগঞ্জ ছেড়ে পাড়ি জমায় থাইল্যান্ডে। পরে আবার তিনি দেশে গোপনে ফিরে আসেন।

পোস্টারিং গ্রেপ্তার হতে না হতেই নারায়ণগঞ্জ বিএনপিতে যেন নতুন আলোচনার জন্ম নিয়েছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে দেয়ালে দেয়ালে শোভা পাচ্ছে জাকির খানের মুক্তির দাবীতে পোস্টার।

বহু এলাকায় পোস্টারে ছেয়ে ফেলা হয়েছে। জাকির খানের নানান সমর্থক ও অনুসারীরা এসব পোষ্টার লাগিয়ে তার পুনরুত্থান যেন জানান দিচ্ছেন। আদালত পাড়া থেকে শুরু করে পাড়া মহল্লা সর্বত্র জাকির খানের
পোষ্টারে ছেয়ে ফেলা হয়েছে।

নতুন রাজনীতিতে আসা অনেকের মনেই প্রশ্ন জেগেছে। এতদিন পর গ্রেপ্তার হওয়া এই জাকির খান আসলে কে? কি বা তার পরিচয়?

নিউজটি শেয়ার করুণ