নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানার পশ্চিম দেওভোগ আদর্শনগর এলাকায় ময়লার স্তূপ থেকে তানজিনা (২৮) নামে এক নারীর ১৯টি হাড়গোড় উদ্ধার করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
প্রায় ১১ মাস আগে ওই নারীকে হত্যার পর ১০ টুকরো করে মাথা একটি ডোবায় ফেলে দেয় তার স্বামী রাসেল। দেহের বাকি অংশগুলো ফ্রিজে সংরক্ষণ করার পর বিভিন্ন সময়ে ময়লার স্তূপে ফেলে দেয়।
গ্রেপ্তার রাসেলের দেয়া তথ্যানুযায়ী বৃহস্পতিবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) দিনব্যাপী ময়লার স্তূপে তল্লাশি চালিয়ে ওই নারীর দেহাবশেষ উদ্ধার করা হয়েছে।

নিহত তানজিনা রংপুর জেলার আব্দুল জলিলের মেয়ে। রংপুরের মিঠাপুকুর থানার এনায়েতপুর গ্রামের রাসেল মিয়ার সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল। তারা ফতুল্লার মাসদাইর বাড়ৈভোগ এলাকার সিরাজ খানের বাসায় ভাড়া থাকতেন। পারিবারিক কলহের জেরে রাসেল তার স্ত্রী তানজিনাকে গলা কেটে হত্যা করেন।
রাসেল তার স্ত্রীর দেহ কয়েক টুকরা করে বাড়ির পাশের ডোবায় ফেলে দেন। পরে রাসেল তার বাড়িওয়ালা সিরাজ খানকে জানান, তার স্ত্রী তানজিনা করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে মারা গেছেন। এরপর তিনি বাসা ছেড়ে চলে যান।
পরে ২০২১ সালে ৫ এপ্রিল মাসদাইর বাড়ৈভোগ এলাকার ফারিয়া গার্মেন্টসের সামনের ওই ডোবা থেকে অজ্ঞাত পরিচয়ে তানজিনার দেহবিহীন মাথা উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করে ফতুল্লা মডেল থানায় মামলা করে পুলিশ। এ মামলার তদন্তের দায়িত্ব পেয়ে রহস্য উদ্ঘাটন শুরু করে পিবিআই।
নারায়ণগঞ্জ পিবিআইয়ের উপপরিদর্শক (এসআই) শাকিল হোসেন জানান, ‘গত মঙ্গলবার রংপুর থেকে রাসেলকে গ্রেপ্তারের পর জানা যায়, মাথাটি যে ডোবায় পাওয়া গেছে সেখানেই দেহ কয়েক টুকরা করে ফেলে দেওয়া হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার সকাল থেকে সেই ডোবায় সেচ মেশিন দিয়ে পানি সরানোর পর বিকেলে ওই নারীর দেহের বিভিন্ন অংশ প্রায় ১৯টি হাড়গোড় উদ্ধার করা হয়।’
তিনি আরও জানান, ‘আসামির দেওয়া তথ্যমতে আমরা এরই মধ্যে হত্যায় ব্যবহৃত একটি দা জব্দ করেছি। এ ছাড়া যে ফ্রিজটি ব্যবহার করা হয়েছিল সেই ফ্রিজটিও জব্দ করা হয়েছে।’

ঘটনার বিবরণে জানা গেছে, ২০২১ সালের ৫ এপ্রিল দুপুরে ফতুল্লা থানাধীন বাড়ৈভোগ বটতলা এলাকার বলয় ও আকালের বাড়ির পেছনে ডোবার মধ্যে অজ্ঞাত মহিলার খণ্ডিত মাথা পাওয়া যায়। পরবর্তীতে থানা-পুলিশ উক্ত বিষয়ে সংবাদ পেয়ে কর্তব্যরত এসআই আশিক ইমরান ঘটনাস্থলে এসে উক্ত অজ্ঞাত মহিলার গলাকাটা মাথা উদ্ধার করে বিধি মোতাবেক সুরতহাল রিপোর্ট প্রস্তুত করে ময়নাতদন্তের ব্যবস্থা করেন।

পরে ফতুল্লা মডেল থানায় কর্মরত এসআই (নি.) আশিক ইমরান বাদী হয়ে ফতুল্লা থানায় মামলা করেন। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে মামলাটির তদন্তভার দেয়া হয় পিবিআইকে।
নারায়ণগঞ্জ জেলা পিবিআইয়ের পুলিশ পরিদর্শক (নি.) একেএম নাসির উল্ল্যাহ্ মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করেন। তার বদলিজনিত কারণে পরবর্তীতে মামলাটির তদন্তভার অর্পিত হয় পুলিশ পরিদর্শক (নি.) সাইফুল আলমের ওপর।
তদন্তকালে তিনি তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় মামলার ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে গত মঙ্গলবার রংপুর জেলার মিঠাপুকুর থানাধীন এনায়েতপুর হতে মো. রাসেলকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই নারায়ণগঞ্জ জেলা কার্যালয়ে হাজির করেন।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার রাসেল স্বীকার করেন যে, গলাকাটা মাথাটি তার স্ত্রী তানজিনার।
অভিযুক্ত রাসেল ২০১০ সালের দিকে জীবিকার তাগিদে ঢাকার সাভার এলাকায় আসেন। ২০১৫ সাল পর্যন্ত সাভারের সানি ট্রেডার্স নামের একটি সিমেন্টের দোকানে চাকরি করেন। পরে নারায়ণগঞ্জের রনি নিট গার্মেন্টসে কাজ নেন।
এর মধ্যে তার গ্রামের তানজিনার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে রাসেলের। কিন্তু রাসেলের শারীরিক গঠন খর্বাকৃতির ও কালো বর্ণের হওয়ায় তানজিনার পরিবার তাদের সম্পর্ক মেনে নেননি। পরে ২০১৯ সালে মোনালিসা নামের এক মেয়ের সঙ্গে পারিবারিকভাবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। এই খবর তানজিনা জানতে পেরে বাড়ি থেকে পালিয়ে নারায়ণগঞ্জে চলে আসেন। এসে তিনিও গার্মেন্টসে কাজ নেন।
এ সময় রাসেলের সঙ্গে তানজিনার পুনরায় প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে এবং তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এরপর থেকে তারা ফতুল্লা থানাধীন পশ্চিম দেওভোগ আদর্শ নগর রঙ্গিলা রোডের মো. নোয়াবের বাড়িতে ভাড়ায় বসবাস শুরু করেন। কিন্তু বিবাহের পর থেকে তানজিনা রাসেলের মৃত বোনের স্বামী মোস্তফাসহ আরো দুয়েক জনের সঙ্গে গোপনে কথা বলা শুরু করেন। এই বিষয়টি নিয়ে তাদের দাম্পত্য কলহ তৈরি হয়।
ঘটনার দিন গত বছরের ২৯ মার্চ ৩টায় শবে বরাতের নামাজ শেষে বাড়ি ফিরে রাসেল তানজিনাকে অন্যত্র মোবাইলে কথা বলতে দেখে রাগান্বিত হয়ে মারপিট করেন। একপর্যায়ে রাসেল ক্ষিপ্ত হয়ে বটি দিয়ে তানজিনার গলায় আঘাত করেন। পরে রাসেল বটি দিয়ে ভুক্তভোগীর মাথা কেটে আলাদা করে ফেলেন। এবং হাত-পা সহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ টুকরো টুকরো করে ফ্রিজে রেখে দেন।
বিভিন্ন সময়ে খণ্ডিত দেহের বিভিন্ন অঙ্গ তার বাসার ছাদ থেকে পার্শ্ববর্তী ময়লার স্তূপের মধ্যে ফেলে দেন। গত বছরের ৪ এপ্রিল গভীর রাতে ভুক্তভোগীর খণ্ডিত মাথা একটি প্লাস্টিকের ব্যাগে ভর্তি করে ফতুল্লার বাড়ৈভোগ বটতলা সাকিনের আকালের বাড়ির পেছনের ডোবার মধ্যে ফেলে দেন।
এই ঘটনার পরে অভিযুক্ত রাসেল ওই বাসা ছেড়ে হত্যার কাজে ব্যবহৃত বটি নিয়ে গোপনে পালিয়ে যান এবং সোনারগাঁয়ের ছোট সাদিপুর এলাকায় জনৈক ফিরোজ হোসেনের একটি টিনশেড ঘরে ওঠেন।
পরে ভুক্তভোগীর আত্মীয়স্বজন তান খোঁজ খবর না পেয়ে ফতুল্লা থানায় একটি নিখোঁজ জিডি করেন। ওই জিডির সূত্র ধরে থানা থেকে অভিযুক্তকে ফোন দিলে তিনি সোনারগাঁ থেকে পালিয়ে যান। তার ব্যবহৃত মোবাইল বন্ধ করে বিভিন্ন সময়ে নামে বেনামে ২৫টি মোবাইল এবং ১৫টি সিম ব্যবহার করেন।
এ ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জ পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার (এসপি) মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘এ ঘটনায় অভিযুক্ত রাসেলকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নিহত নারীর শরীরের বিভিন্ন অংশ উদ্ধার করা হয়েছে’।
সূত্রঃ লাইভ নারায়ণগঞ্জ
